হিন্দি ছবিতে ত্রিশের ও চল্লিশের দশকে সাধারণত খলনায়িকারা হতেন যৌন আবেদনময়ী। দেবিকা রানি, নিম্মি, সুরাইয়ার মতো নায়িকারা যখন পর্দায় নিষ্পাপ প্রেমের অবতার হয়ে এসেছেন সে সময় নাদিরার মতো খলনায়িকারা হয়েছেন সেক্স সিম্বল।
‘নিচা নগর’ ছবিতে নায়িকা হিসেবে বাণিজ্যিক সাফল্য পান কামিনী কৌশল। পর্দায় সুঅভিনয়ের জন্য যেমন তার খ্যাতি ছিল তেমনি যৌন আবেদনের জন্যও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। যদিও সাদাত হোসেন মান্টো তার ‘গাঞ্জে ফারিশতে’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে, বাস্তবে কামিনী কৌশলের দেহ সৌষ্ঠব খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না।
পঞ্চাশের দশকে যৌন আবেদনময়ী হিসেবে খ্যাতি পান নাদিরা। ১৯৫২ সালে ‘আন’ ছবি দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। সেখানে তিনি সাহসী দৃশ্যে অভিনয় করেন। ১৯৫৫ সালে ‘শ্রী ৪২০’ ছবিতে মায়া নামে এক বিলাসী নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ‘মুর মুরকে না দেখ’ গানের সঙ্গে নাদিরার নৃত্য ছিল উত্তেজক। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে নিষ্পাপ ও সতী-সাধ্বী ইমেজের নায়িকাদের বিপরীতে ‘ভ্যাম্প’ হিসেবে বখাটে, লাস্যময়ী কিংবা আবেদনময়ীর চরিত্রে দারুণ মানানসই ছিলেন নাদিরা।
ষাট ও সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বলিউডের সবচেয়ে আবেদনময়ী অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী ছিলেন হেলেন। মধুবালা ও বৈজয়ন্তিমালার দাপুটে উপস্থিতি সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য। ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছবিতে বৃষ্টিস্নাত মধুবালার সৌন্দর্য এবং ‘সংগম’ ছিবিতে বৈজয়ন্তিমালার শরীরি আবেদন যতই থাক সে সময় যৌনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন হেলেন। ‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবিতে ‘মেরা নাম চিনচিন চু’ গানের সঙ্গে হেলেন যখন ক্যাবারে নাচে পর্দা কাঁপালেন তখন থেকেই হিন্দি ছবিতে তিনি যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন। হেলেন নায়িকা নন। ভ্যাম্প বা খলনায়িকা কিংবা ক্যাবারে শিল্পীরূপেই তার পর্দায় বিচরণ। সত্তরের দশকে ‘ক্যারাভান’ ছবিতে ‘পিয়া তু আব তো আজা’ গানের সঙ্গে হেলেনের ক্যাবারে নৃত্য অসাধারণ। ‘শোলে’ ছবিতে ‘মেহবুবা
মেহবুবা’ গানের সঙ্গে তার নাচও অনন্য। যৌন আবেদনের দিক থেকে সে সময় হেলেন হলিউডের র্যাকুয়েল ওয়েলসের সঙ্গে তুলনীয় ছিলেন। ‘ডন’ ছবিতে ‘ইয়ে মেরে দিল পেয়ার কি দিওয়ানা’ গানে হেলেনের নৃত্যের আবেদনকে অতিক্রম করতে পারেননি ছবিটির রিমেইকে ওই একই নাচে কারিনা কাপুরের মতো সুন্দরী নায়িকাও। ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ ছবিতে বিকিনি পরে চমক সৃষ্টি করেন শর্মিলা ঠাকুর। খ্যাতির শীর্ষে থাকলেও সিনেমায় খোলামেলা পোশাক খুব একটা পরেননি তিনি। বরং তার চেহারা, বিশেষ করে গালের টোলে ছিল মূল আবেদন।
সত্তরের দশকে পর্দায় হেলেনের পাশাপাশি যৌনতার প্রতীক হযে ওঠেন বিন্দু, অরুণা ইরানি, বিনার মতো অভিনেত্রীরা। তবে এদের সবাইকে পিছনে ফেলে নতুন চমক নিয়ে আসেন জিনাত আমান। জিনাত আমানের আগে নায়িকারা ছিলেন মূলত ‘নিষ্পাপ ভালোবাসা’র প্রতীক। কিন্তু সতী-স্বাধ্বী ও নিষ্পাপ ইমেজ ঝেড়ে খোলামেলা পোশাকে পর্দা কাঁপান জিনাত আমান। সেসময় থেকেই চলচ্চিত্রে যৌনতার রূপও পাল্টে যেতে থাকে।
রাজকাপুর পরিচালিত শশী কাপুর ও জিনাত আমান অভিনীত ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ যৌনতার জন্য আলোচিত ছবি। এটি প্রেম এবং রূপের দ্বন্দ্ব নিয়ে নির্মিত ছবি। তবে দর্শকের মনে যতই চমক লাগুক একথা মনে হতেই পারে যে, এখানে অকারণ যৌনতার আগুনে পুড়ে গেছে প্রেম। এই ছবিতে অন্তর্বাস ছাড়া সাদা শাড়িতে ঝরনার নিচে জিনাত আমানের শরীরী আবেদন দুর্দান্ত। ‘কুরবানি’ ছবিতে ‘লায়লা ও লায়লা’ গানের সঙ্গে জিনাত আমানের অভিব্যক্তি ছিল আবেদনে ভরপুর। ড্রিম গার্ল হেমা মালিনী ও বেবি ডল শ্রীদেবী মূলত তাদের সৌন্দর্যের জন্য আলোচিত হলেও কখনও কখনও পর্দায় তারা যৌনতার রূপকারও হয়েছেন।
আশির দশকে যৌনতার বহিঃপ্রকাশ স্থূলভাবে ঘটতে শুরু করে। সে সময় প্রায় প্রতিটি ছবিতে একটি বা একাধিক ধর্ষণদৃশ্যের মাধ্যমে দর্শককে বিকৃত যৌনতার সুড়সুড়ি দেওয়া হতো। ‘ইনসাফ কা তারাজু’ ছবিতে জিনাত আমান ও পদ্মিনী কোলাপুরী হন ধর্ষণের শিকার। সত্তর দশকের শেষে ও আশির দশকে শ্রীদেবী ও রেখা পরিশীলিত যৌনতার আমেজ নিয়ে আসেন।‘সিলসিলা’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চন ও রেখার অন্তরঙ্গ দৃশ্যে যৌনতা ছিল দারুণ পরিশীলিত। আবার ‘কাভি কাভি’ ছবিতে রাখি ও শশীকাপুরের বাসর দৃশ্যের রূপায়নও ছিল এই সঙ্গে যৌন আবেদন ও বেদনায় বিধুর। অন্যদিকে আশির দশকেই নাগ-নাগিনির ও ভৌতিক ছবিতে চলে স্থূল যৌনতার চর্চা। ভৌতিক ছবিগুলো সেসময় কুখ্যাত ছিল খোলামেলা পোশাক ও উত্তেজক দৃশ্যের জন্য। আর সাপের ছবিতে মূলত থাকতো আবেদনময় নাচ।
আবেদনময়ী নায়িকা হিসেবে সেসময় বিখ্যাত হন পারভীন ববি, মন্দাকিনী ও কিমি কাতকার। ‘রাম তেরি গঙ্গা মাইলি’ ছবিতে সাদা শাড়িতে ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে শরীর দৃশ্যমান করে আলোচিত হন মন্দাকিনী। আর ‘টারজান’ ছবিতে স্বল্প পোশাকে বিচরণ করে খ্যাতি পান কিমি কাতকর। ‘হাম’ ছবিতে অমিতাভের বিপরীতে ‘জুম্মা চুম্মা দে দে’ নাচের সঙ্গে কিমি ছিলেন দুর্দান্ত। ‘অন্দর বাহার’ ছবিতে বিকিনি পরে আলোচনায় আসেন মুনমুন সেন। তিনি খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয় করে সে সময় যৌনতার প্রতীক হয়ে উঠতে চাইলেও ব্যর্থ হন দারুণভাবে| সে সময় বরং যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠেন সিল্ক স্মিতা। এই দক্ষিণী অভিনেত্রী মূলত তামিল ছবিতে অভিনয় করলেও হিন্দি ছবিতেও তার দাপট কম ছিল না।‘সিদ্ধার্থ’ ছবিতে সিমি গারেওয়াল প্রাচীন ভারতীয় খোলামেলা পোশাকে আবির্ভুত হন। অন্যদিকে প্রাচীন সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিক অবলম্বনে নির্মিত ‘উৎসব’ ছবিতে খোলামেলা পোশাকে রেখা হয়ে ওঠেন অপরূপা। পৌরুষদীপ্ত দেহের কারণে আশির দশকে হেমন্ত, বিনোদ খান্না এবং নব্বইয়ের দশকে সঞ্জয় দত্ত এবং পরবর্তীতে সালমান খান আলোচনায় আসেন।
নব্বইয়ের দশকে বলিউডে যৌনতার প্রকাশ ছিল মূলত নাচের মাধ্যমে। শুধু নৃত্য ভঙ্গিমা নয়, গানের কথাগুলোও ছিল যৌনগন্ধী। কণ্ঠে লাস্য নিয়ে আসেন ইলা অরুণ, আলিশা চিনয়। আর বরাবরই আশা ভোঁসলে ছিলেন চটুল গানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আইটেম সং নামক অভিধাটি তখনও সেভাবে প্রচলিত হয়নি। তবে আশির দশকের শেষে মাধুরী দিক্ষিত তেজাব ছবিতে ‘এক তো তিন’ নাচের মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে ‘ধক ধক করনে লাগা’, ‘চোলি কা পিছে কেয়া হায়’ ইত্যাদি গানের সঙ্গে মাধুরীর নৃত্য অসামান্য আবেদন সৃষ্টি করে। কমেডি ছবিতে যৌনাবেদনময় নাচের কারণে আলোচিত হন কারিশমা কাপুর ও গোবিন্দা।
পরবর্তিতে ‘রঙিলা’ কিংবা ‘দৌড়’-এর মতো সিনেমায় ঊর্মিলা ছিলেন অনন্য। মমতা কুলকার্নি, পূজা বেদী, অনু আগারওয়াল যৌন আবেদনময়ী নায়িকার খেতাব পেলেও মাধুরী দিক্ষিতের নৃত্যের আবেদনকে অতিক্রম করতে পারেননি। নব্বইয়ের দশকে আরেক ধরনের চলচ্চিত্র যৌনতাকে পূজি করে গড়ে ওঠে।‘কামসূত্র’ ছিল প্রাপ্ত বয়স্কদের ছবি। সে ছবিতে প্রাচীন ভারতের পটভূমিতে মূলত যৌনতাই চিত্রিত হয়েছে।‘ব্যানডিট কুইন’ও ছিল প্রাপ্ত বয়স্কদের ছবি | ফুলন দেবীর জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ছবিটিতে যৌনতার অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যায়ন ছিল বললে ভুল বলা হয় না। পূর্বজন্ম ও থ্রিলারধর্মী ‘মনসুন’ও প্রাপ্তবয়স্কদের ছবি।
নব্বই দশকের শেষ দিকে এবং নতুন শতকের প্রারম্ভে রম্ভা, রামাইয়া, অন্তরা মালি, মল্লিকা শেরওয়াত যৌন আবেদনময়ী হিসেবে পরিচিত ওঠেন। ‘মার্ডার’ ছবিতে শুরু হয় যৌনতার নতুন ধারা। সেই সঙ্গে এমরান হাশমি নায়কের ‘নিষ্পাপ প্রেমিক’ ইমেজ ঝেড়ে ফেলে আধুনিক যুগের অভিজ্ঞ পুরুষের ভূমিকায় পর্দায় আসেন। চুম্বন দৃশ্যের জন্য খ্যাতিমান এমরান হাশমির উপাধি জোটে ‘সিরিয়াল কিসার’। যদিও এর আগে ‘জিসম’ ছবিতে জন আব্রাহাম তার দেহ সৌষ্ঠবের কারণে সেক্স সিম্বল হয়ে ওঠেন তবু এমরান তাকে ছাড়িয়ে গেছেন নিঃসন্দেহে। পূজা ভাট তার জিসম ছবির মাধ্যমে বলিউডে সেক্স থ্রিলারের নতুন ধারা আনেন যেখানে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ‘নায়িকা’ হয়ে ওঠে ‘খলনায়িকা’। ‘জিসম’, ‘আজনাবি’ প্রভৃতি ছবির মাধ্যমে বলিউডে যৌনতার নতুন প্রতীক হন বিপাশা বসু। ‘কাভি আল বিদা না কেহনা’ এবং ‘চলতে চলতে’ ছবিতে শাহরুখের সঙ্গে শয্যাদৃশ্যে অংশ নিয়ে রানি মুখার্জিও পর্দায় যৌনতার রূপায়ন করেন কিন্তু তা ছিল পরিশীলিত। নব্বইয়ের দশক থেকেই যৌনতার অংশ হিসেবে পুরুষের শরীর প্রদর্শনের ধারা চলছে। শার্ট ছাড়া পর্দায় আসতেই অভ্যস্ত হযে পড়েছেন সালমান খান। সম্প্রতি হৃতিক রোশানও তার পেশী প্রদর্শন করে আলোচিত হয়েছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম ছবি ‘সাবারিয়া’তে তোয়ালে পরে আলোচিত হয়েছিলেন রানবির কাপুর।‘রামলীলা’ ছবিতে রানভির সিং তার দেহ সৌষ্ঠব প্রদর্শন করেছেন।
নতুন শতকে আইটেম গান নাম দিয়ে যৌনতা প্রদর্শনের নতুন ধারা শুরু হয়। আইটেম গান মানেই যৌনতার প্রদর্শনী। প্রতিটি ছবিতেই কোনো না কোনো আইটেম গান থাকতেই হবে ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যের স্বার্থে।‘ইশক কমিনা’, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’, শিলা কি জাওয়ানি’, ‘রাম চাহে লিলা’সহ অসংখ্য আইটেম গান বলিউডি সিনেমায় যৌনতাকে ধারণের পাত্র হয়ে দাড়িয়েছে ।
শুধু আইটেম গানের সঙ্গে নাচের জন্য মালাইকা আরোরা যেমন খ্যাতি পেয়েছেন তেমনি কারিনা কাপুর, ক্যাটরিনা কাইফ,দিপিকা পাড়ুকোন, প্রিয়াংকা চোপড়াসহ প্রত্যেক নায়িকাই কোনো না কোনো আইটেম গানে ঝড় তুলেছেন। সিল্ক স্মিতার জীবন নিয়ে নির্মিত ‘ডার্টি পিকচার’ ছবিতেও কাহিনির প্রয়োজনে এসেছে যৌনতা। ‘পারিনিতা’ ছবিতে সাইফ আলি খানের সঙ্গে শয্যা দৃশ্যে অংশ নিয়েছেন বিদ্যা বালান। নতুন শতকে কমেডি ছবিতে যৌনতার ব্যবহার পৃথক একটি ধারা। এ ধারায় ‘ম্যায়নে পেয়ার কিউ কিয়া’, ‘কেয়া কুল হায় হাম’, ‘নো এন্ট্রি’সহ বিভিন্ন কমেডি ছবি রয়েছে।
‘জিসম টু’, ‘হেইট স্টোরি’, ‘রাগিনি এমএমএস টু’র মতো ছবির মাধ্যমে শুরু হয়েছে বলিউডে ইরটিক থ্রিলারের নতুন ধারা। সাবেক ইন্দো-কানাডিয়ান পর্ন তারকা সানি লিওনির ইমেজকে পুঁজি করে কিছু ছবি ব্যবসা সফল হয়েছে বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। বলিউডের নতুন সেক্স সিম্বল এখন তাই সানি লিওনি। তবে শুধু যৌনতাকে পুঁজি করে তিনি কতদূর সফল হবেন তা সময়ই বলে দেবে।